শস্য উৎপাদন

ভুট্টার পরিচিতি

পৃথিবীর মানচিত্রে ভুট্টা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তণ্ডুল জাতীয় ফসল। একমাত্র অ্যান্টার্টিকা ছাড়া পৃথিবীর সর্বত্রই ভুট্টার চাষের চল আছে। কেননা বিবিধ জলহাওয়া মানিয়ে নিয়ে যথার্থ ফলন দেওয়ার অনুপম ক্ষমতা আছে ফসলটির। নিরক্ষীয় নিচু জমি থেকে শুরু করে সমুদ্রতট থেকে ১২০০০ ফুট উঁচু জমিতেও ভুট্টার সফল চাষ সম্ভব। তণ্ডুল জাতীয় যতগুলো ফসল আছে ফলন ক্ষমতায় ভুট্টা সর্বোত্তম। হেক্টর পিছু ২৭ টন ফলনেরও রেকর্ড আছে আমেরিকায়। সারা পৃথিবীতে কম-বেশি ১১৬ লক্ষ হেক্টর জমিতে ভুট্টার চাষ হয়। উৎপাদন হয় ৮০০০ লক্ষ টন। ভুট্টার চাষ সর্বাধিক আমেরিকায়। ভারতেও সবক’টি রাজ্যেই এই ফসলটির চাষ হয়। সর্বাপেক্ষা বেশি চাষ হয় উত্তরপ্রদেশে। পশ্চিমবঙ্গে বর্তমানে খরিফ, রবি ও প্রাক খরিফ মিলিয়ে প্রায় সোয়া লক্ষ হেক্টরে ভুট্টার চাষ হচ্ছে।
ভুট্টা একটি অত্যন্ত পুষ্টিকর তণ্ডুল। অন্যান্য তণ্ডুল শস্য অপেক্ষা ভুট্টার দানায় প্রোটিনের পরিমাণ বেশি থাকে (১১ – ১২%) এবং বর্তমানে লাইসিন যুক্ত হওয়ার কারণে গুণমানেও উৎকৃষ্ট। এ ছাড়া খনিজ পদার্থ ও আঁশের আধিক্যও ফসলটিকে ক্রমশ পৃথিবীর সব দেশের মানুষের ভোজ্য তণ্ডুল হিসাবে ব্যবহারে যোগ্য করে তুলেছে। আমাদের দেশেও বহু দিন ধরেই প্রান্তিক মানুষদের প্রিয় খাদ্য ভুট্টা। ক্রমশ পুষ্টিগুণের কল্যাণে বিত্তবানের হেঁসেলেও ঢুকছে। শহর ও শহরতলির মলে ‘মাল্টিগ্রেন আটার’ অন্যতম উপাদান ভুট্টা। এ ছাড়াও পপকর্ন, কর্নফ্লেক্স ও লেবু মাখিয়ে অপরিপক্ক ভুট্টা এখন সারা দেশে এমনকী পশ্চিমবঙ্গেও যথেষ্ট জনপ্রিয়। তবে এ কথা ঠিক সারা পৃথিবীতেই উৎপাদিত ভুট্টার সিংহ ভাগ ব্যবহৃত হয় পশুখাদ্য হিসাবে (৬১%)। কেবলমাত্র ১৭% ব্যবহৃত হয় মানুষের খাদ্য হিসাবে। বর্তমানে আমেরিকায় ভুট্টার দানা থেকে তৈরি হচ্ছে ‘বায়োফুয়েল’। বাকিটা শিল্প।
ভুট্টা একটি শিল্প-বান্ধব ফসল। ভুট্টার দানা ব্যবহার করে তৈরি হচ্ছে স্টার্চ, চিনি, সিরাপ, অ্যালকোহল, প্রোটিন ইত্যাদি। আমেরিকার বায়োফুয়েল উৎপাদনের একটা বড় উৎস ভুট্টার দানা। ভুট্টার বর্জ্য যেমন ভুট্টার গাছ ও দানার ডাঁটা (কব) থেকে কাগজ, কার্ড বোর্ড, প্লাস্টিক, অ্যাসিটিক অ্যাসিড, পাইপ ইত্যাদি বহুবিধ শিল্পজাত দ্রব্য প্রস্তুত হচ্ছে।
কৃষির পরিমণ্ডলে ফসলটির গুরুত্ব ক্রমশ বাড়ছে। তার কারণ এই ফসল চাষে জলের চাহিদা কম এবং আবহাওয়ার উষ্ণায়নে ধান–গম অপেক্ষা অনেক বেশি সহনশীল।

ভুট্টার জন্মকথা

উদ্ভিদ বিজ্ঞানের অভিধানে ভুট্টার দ্বিপদ নাম ‘জিয়া মেস’। জিয়া একটি গ্রিস দেশীয় শব্দ। অর্থ দানা। মেস শব্দটির উৎস ওয়েস্ট ইন্ডিয়া। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ায় ‘মেস’ বলতে কর্ণকে বোঝায়। প্রত্নতাত্তিকদের মতে ভুট্টার জন্ম মেক্সিকোতে। কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের পর তার হাত ধরেই ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে ভুট্টার চাষ। ঐতিহাসিকদের মতে সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে পর্তুগিজ ঔপনিবেশকগণ ভারতবর্ষে ভুট্টার চাষ প্রবর্তন করে।
পৃথিবী জুড়ে আজ যে ভুট্টার চাষ চলছে প্রকৃতিতে তার কোনও অস্তিত্ব ছিল না। ঠিক কী ভাবে প্রকৃতিতে ভুট্টার জন্ম হল তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ আছে। এক দল বিজ্ঞানীর অভিমত আজ থেকে ৭০০০ বছর আগে দানা উৎপাদনকারী বন্য ঘাস জাতীয় উদ্ভিদ ‘টিওসিনাইট’ থেকেই ভুট্টার জন্ম। টিওসিইনাইট থেকে ভুট্টার এই বিবর্তনের কাণ্ডারী মানুষ। মানুষের প্রয়োজনে বন্য ঘাসকে পোষ মানিয়ে নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য হিসাবে চাষ করতে করতেই প্রকৃতির কোলে টিওসিনাইট ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হয় আজকের ফসল ভু্ট্টায়। বিজ্ঞানীদের অন্য গোষ্ঠীর মতে,টিওসিনাইট নয় বন্য ঘাস ট্রিপসিকাম ভুট্টার জনক। এই দু’ ধরনের ঘাস আজও পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে দেখতে পাওয়া যায়।
টিওসিনাইট অথবা ট্রিপিসকাম,যেই ভুট্টার জনক হোক না কোন,প্রকৃতিতে তৈরি হয়েছিল ভুট্টার প্রায় ১০০ ধরনের প্রজাতি। এর মধ্যে ভুট্টার মাত্র দু’ ধরনের কৃষকদের মন কাড়ে। একটির নাম ফ্লিন্ট। অন্যটির ডেন্ট। দানাশস্য হিসাবে ফ্লিন্টের চাষ হত উত্তর আমেরিকায়। ডেন্টের দক্ষিণ আমেরিকায়। এই দু’ ধরনের প্রজাতির বিপরীত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ
প্রজাতি/চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য
ফ্লিন্ট
ডেন্ট
গাছের বৈশিষ্ট্য
১ উচ্চতা
গাছ বেঁটে
গাছ লম্বা
২ মেয়াদ
জলদি মেয়াদি
অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ মেয়াদি
৩ কাণ্ডের প্রকৃতি
কাণ্ড সরু
কাণ্ড মোটা
খ দানার চরিত্র
১ রঙ
সাধারণত হলুদ অথবা কমলা। অন্যান্য রঙও দেখা যায়।
হলুদ অথবা সাদা
২ প্রকৃতি
পাথরের টুকরোর মতো শক্তপাকলেও সংকুচিত হয় না
দানা অপেক্ষাকৃত নরম। পাকলে দানার ওপর খাঁজ পড়ে
৩ দানা ধারণকারী ডাঁটার (কবপ্রকৃতি
ডাঁটায় সাধারণত ৮ সারি দানা
ডাঁটায় ১৬ – ৩০ সারি দানা
৪ ডাঁটার সংখ্যা
প্রতিটি কাণ্ডে একাধিক ডাঁটা বা কব হতে পারে
কাণ্ড প্রতি সাধারণত একটি ডাঁটা বা কব

প্রকৃতিতে উপরোক্ত দুই প্রজাতির স্বত:স্ফুর্ত সংকরায়নে উদ্ভূত হয় ভুট্টার নতুন প্রজাতি — ‘কর্ন বেল্ট ডেন্ট ’। বর্তমানে সারা পৃথিবীতে যে সঙ্কর জাতের ভুট্টা চাষ হচ্ছে তা এই নতুন প্রজাতির বংশধর।
তথ্যসূত্র:ইনস্টিটিউট অব এগ্রিকালচারাল সায়েন্স,কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়

ভুট্টার নানান নাম

  1. পড কর্ন
  2. পপ কর্ন
  3. ডেন্ট কর্ন
  4. লিন্ট কর্ন
  5. ফ্লাওয়ার কর্ন
  6. সুইট কর্ন
  7. ওয়াক্সি কর্ন
মূলত দানার ব্যবহার ও বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে ভুট্টা নানান নামে পরিচিত। নামের সংখ্যা সাত। যথা —
  • ১) পড কর্ন
  • ২) পপ কর্ন
  • ৩) ডেনট কর্ন
  • ৪) ফ্লিন্ট কর্ন
  • ৫) ফ্লাওয়ার কর্ন
  • ৬) সুইট কর্ন
  • ৭) ওয়াক্সি কর্ন

পড কর্ন

এই ভুট্টার প্রতিটি দানা মোচার খোলের মতো পরিবর্তিত পাতা অর্থাৎ হাস্ক দ্বারা আবৃত থাকে এবং সম্পূর্ণ শিষটিও হাস্ক দ্বারা ঢাকা থাকে। অনেকটা বন্য জাতের মতো বলে এর বেশি গুরুত্ব নেই।

পপ কর্ন

এই ভুট্টার গাছে শিষ ও দানা বেশ ছোট। দানাগুলি খুব শক্ত। তাপ দিলে ফুটে উঠে এবং খৈ-এর মতো দেখায়। এর দানাগুলি সাদা, হলদে বা বেগুনি রঙের হতে পারে।

ডেন্ট কর্ন

এই জাতের ভুট্টা পুষ্ট হলে বা পাকলে দানার উপরে সম্মুখ ভাগে খাঁজ পড়ে। ভুট্টার দানার পাশে শক্ত স্টার্চ (শ্বেতসার) এবং মধ্য ভাগে নরম স্টার্চ থাকে। দানা পাকলে নরম স্টার্চ শুকিয়ে ও সংকুচিত হয়ে এই খাঁজ ঘটায়। এই জাতের ভুট্টা সর্বাধিক পরিমাণে চাষ হয়। দানার রঙ হলদে বা সাদা হতে পারে। গাছ বেশ লম্বা। পাশকাঠি বের হতে পারে এবং উৎপাদনও বেশি হয়। এই ভুট্টার শিষ ১৫ থেকে ৩৫ সেমি পর্যন্ত লম্বা হয় । এর প্রতিটি শিষে ১৬ থেকে ৩০ সারি দানা থাকতে পারে।

লিন্ট কর্ন

এই জাতের ভুট্টার দানা পাথরের টুকরোর মতো শক্ত হয় বলে একে ‘ফ্লিন্ট কর্ন’ বলে। এই ভুট্টার দানার শাঁসের মধ্য ভাগের নরম স্টার্চ বহিঃত্বকের খুব শক্ত স্টার্চ দ্বারা সম্পূর্ণ রূপে আবৃত থাকে; ফলে পাকলেও দানা সংকুচিত হয় না। দানাগুলি সাধারণত গোল থাকে, কোনও কোনও সময় ছোট এবং চ্যাপটাও হয়। এই ভুট্টা খুব জলদি জাতের এবং এর দানা বিভিন্ন রঙের হতে পারে। ভারতে হলদে থেকে কমলা রঙের স্বল্পকাল স্থায়ী ফ্লিন্ট ভুট্টাই বেশি পরিমাণে চাষ হয়।

ফ্লাওয়ার কর্ন

এই ভুট্টার দানার সমস্ত স্টার্চই নরম। সুতরাং সহজেই পিষে ময়দা করা যায়। যদিও বিভিন্ন রঙের দানা দেখা যায়, তবে সাদা রঙ-ই সচরাচর দেখা যায়। দানা ফ্লিন্ট কর্ন-এর মতো গোল হয়। একে নরম কর্নও বলা হয়।

সুইট কর্ন

এই জাতের ভুট্টার দানা বেশ মিষ্টি বলে অপুষ্ট অবস্থায় খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়। স্বাদে অন্যান্য ভুট্টার চেয়ে মিষ্টি এবং শাঁসে শ্বেতসার ও শর্করা থাকে। দানার রঙ সাদা বা হলদে হয়।

ওয়াক্সি কর্ন

এই জাতের দানার শাঁস কাটলে বা ভাঙলে দেখতে মোমের মতো বলেই ওয়াক্সি কর্ন নাম। দানার ওয়াক্সি স্টার্চের (শর্করা) সাথে আয়োডিন মিশলে দানার শাঁসের রঙ লাল হয়। কিন্তু অন্যান্য দানা আয়োডিনের সংস্পর্শে আসলে নীল রঙ ধারণ করে। এই ধরনের ভুট্টা প্রধানত আঠা জাতীয় দ্রব্য উৎপাদনের কাজে ব্যবহৃত হয়।
তথ্যসূত্র :
  • সার সমাচার
  • পূর্ব ভারতের ফসল
  • ডি এম আর, নিউদিল্লি
  • ইনস্টিটিউট অব এগ্রিকালচারাল সায়েন্স, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়

মাটি ও আবহাওয়া

বেলে-দোঁয়াশ এবং দোঁয়াশ মাটি ভুট্টা চাষের বিশেষ উপযোগী হলেও লাল ও কাঁকুড়ে মাটি অঞ্চলের বাইদ জমিতে এমনকী এঁটেল মাটি অঞ্চলেও এই ফসলের সন্তোষজনক ফলন পাওয়া যায়। তবে মাটির পিএইচ যদি ৬.৫ থেকে ৮.০ এর মধ্যে হয় ও মাটির গভীরতা থাকে তা হলে সেই মাটিতে সর্বোত্তম ফলন পাওয়া যায়। ভুট্টা বৃষ্টিনির্ভর অঞ্চলের জন্য একটি নিশ্চিত ফসল। তবে ফসলের বাড়বৃদ্ধির সংকটময় দশায় মাটিতে রসের টান পড়লে ফলনের জন্য সেচ কার্যকর। তা বলে ভুট্টা মাটিতে দাঁড়ানো জল একেবারেই সহ্য করতে পারে না। তাই বর্ষাকালে ভুট্টা চাষের জন্য উঁচু জমি নির্বাচন করাই শ্রেয়।
ভুট্টা উষ্ণ ও আর্দ্র অঞ্চলের ফসল। বীজের অঙ্কুরোদগম ও চারার বৃদ্ধি ৩২ – ৩৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় ভালো হয়। আবার নিষেকের সময় পরাগধানী থেকে পরাগরেণুর যথাযথ নিষ্ক্রমণের জন্য দিনের তাপমাত্রা ৩০০ সেন্টিগ্রেড থেকে ১০০ সেন্টিগ্রেডের মধ্যে থাকা দরকার। দিনের তাপমাত্রা এই পরিসীমার নীচে অথবা ওপরে চলে গেলে পরাগধানী থেকে পরাগরেণুর নিষ্ক্রমণ কমে যায়। আবার তাপমাত্রা ৩৭০ সেন্টিগ্রেডের ওপরে চলে গেলে পরাগরেণু নষ্ট হয়ে যায়। ফলে নিষেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলন কমে যায়।
মূলত ইতর পরাগেই ভুট্টার ফসলে দানা ধরে। তাই ভুট্টায় ফুল ধরে থাকার সময়ে বৃষ্টিপাত পরাগমিলন ও সুষ্ঠ নিষেকের পরিপন্থী। তাই ফুল ফোটার সময় আবহাওয়ার তাপমাত্রা উল্লিখিত পরিসীমার ভিতরে ও নিয়ন্ত্রিত বৃষ্টিপাত থাকা দরকার। ভুট্টা উষ্ণ অঞ্চলের ফসল বলেই ঠান্ডা আবহাওয়ায় ভুট্টার বাড়বৃদ্ধির বিভিন্ন দশা দীর্ঘায়িত হয়। প্রাক-খরিফ বা খরিফ মরশুমে বীজ অঙ্কুরিত হয়ে গাছ বের হওয়ার পর গাছের ঝুড়ির গঠন সরু হতে যেখানে ২১ – ২৮ দিন সময় লাগে সেখানে রবিখন্দে ৪০ – ৪৫ দিন লাগে। গাছ থেকে পূর্ণাঙ্গ ঝুরি বেরোতে খরিফ ও প্রাক-খরিফে লাগে ৫০ – ৫৬ দিন, রবিতে লাগে ৭২ – ৭৯ দিন।

বোনার সময় ও বীজ বোনা

  1. বোনার সময়
  2. বীজ বোনা

বোনার সময়

ভুট্টা আলোক সংবেদনশীল নয় বলে খরিফ, প্রাক-খরিফ ও রবি, তিন মরশুমেই চাষ করা চলে। পশ্চিমবঙ্গে এই তিন মরশুমেই ভুট্টার চাষ হয়। এই তিনটে মরশুমের মধ্যে খরিফ মরশুমেই ভুট্টা চাষের এলাকা বেশি। প্রাক-খরিফ মরশুমেও ভুট্টার এলাকা উল্লেখযোগ্য। রবি মরশুমে খুব কম এলাকাতেই এ রাজ্যে ভুট্টার চাষ হয়। তবে তিনটে মরশুমের মধ্যে রবিতেই ভুট্টার সব চেয়ে বেশি ফলন পাওয়া যায়। রবি মরশুমে জলের জোগান অনিশ্চিত হলে বোরো ধান অপেক্ষা ভুট্টার চাষ লাভজনক। খরিফ ফসল বোনার উপযুক্ত সময় আষাঢ় – শ্রাবণ (১৫ জুন – ১৫ আগস্ট)। রবি মরশুমে প্রধান ফসল হিসাবে চাষের জন্য কার্তিক মাসের শেষ পক্ষ (নভেম্বর মাসের শেষ পর্যন্ত )। এই সময় ভুট্টার সাথে সাথী ফসল হিসাবে মানানসই রবি ফসলের চাষ করলে কার্তিক মাসের প্রথম পক্ষই (নভেম্বর মাসের প্রথম পক্ষ) ভুট্টা বোনার আদর্শ সময়। প্রাক-খরিফ খন্দের ভুট্টা ফাল্গুনের প্রথম পক্ষের (ফেব্রুয়ারী মাসের শেষ পক্ষ ) মধ্যে বোনা দরকার। তবে কৃষি-জলবায়ু অঞ্চলের প্রকৃতি বুঝে বোনার সময় এমন ভাবে আগু-পিছু করতে হবে যাতে করে ফুল ফোটার সময় বৃষ্টিপাত ও আবহাওয়ার তাপমাত্রা পরাগমিলন ও নিষেকের অন্তরায় হয়ে না দাঁড়ায়।

বীজ বোনা

বর্ষাকালে ভুট্টা চাষের জন্য উঁচু জমি নির্বাচন করা দরকার। রবি ও প্রাক-খরিফ খন্দে উঁচু জমি পরিহার করাই শ্রেয়। বীজ বোনার জন্য চাষের জমি বার বার চাষ দিয়ে মাটি ঝুর ঝুরে করে ফেলতে হবে। অবশ্য জিরো টিলেজ যন্ত্রের সাহায্যে আ-চষা জমিতেও সার সহযোগে বীজ সারিতে সরাসরি বোনা চলে। খরিফ মরশুমে ভুট্টার জমিতে বৃষ্টির জল দাঁড়ানোর কোনও রকম সম্ভাবনা থাকলে জমি চাষের পর মাঠে সারি করে উঁচু বেড তৈরি করে বীজ বোনাই শ্রেয়। কেননা ভুট্টা মাঠে দাঁড়ানো জল সহ্য করতে পারে না। বর্তমানে ভুট্টা চাষের বেড তৈরি করার জন্য বাজারে ট্রাক্টরে টানা ‘বেড শেপার’ যন্ত্র বেরিয়েছে। এই বেড শেপার দিয়ে দক্ষিণ দিক থেকে পুব–পশ্চিমে টানা উঁচু বেড তৈরি করে বীজ বুনলে বীজের অঙ্কুরোদগম ভালো হয়। খরিফ মরশুমে ভুট্টার গোড়ায় বৃষ্টির জল দাঁড়াতে পারে না। দু’টি বেডের মাঝখানের নালি দিয়ে জল বেরিয়ে যায়। আবার রবি বা প্রাক-খরিফ মরশুমে সেচের সুযোগ থাকলে নিয়ন্ত্রিত সেচ দেওয়ার সুবিধা হয়।
মাটির ৩ – ৫ সেমি গভীরতায় বীজ বোনা বাঞ্ছনীয়। সারিতে বীজ বুনলে সারি থেকে সারির দূরত্ব থাকবে ৬০ সেমি এবং প্রতি সারিতে গাছের মধ্যে দূরত্ব হবে ২০ সেমি। ছিটিয়ে বুনলে প্রতি একরে ৮ – ১০ কেজি বীজ এমন ভাবে ছিটোতে হবে যাতে মাঠের সর্বত্র সমান ভাবে বীজ পড়ে। বীজ ছিটিয়ে মই টেনে বীজ ঢেকে দিতে হবে। চারা বেরোনোর পর লক্ষ রাখতে হবে যেন বর্গমিটারে ৬– ৮টি চারা থাকে।
তথ্যসূত্র :
  • টি এম ও পি এবং এম, ভারত সরকার
  • কৃষি দফতর, পশ্চিমবঙ্গ সরকার
  • সার সমাচার, অক্টোবর – ডিসেম্বর, ২০১২

ভুট্টার জাত

  • বহুল ব্যবহৃত জাতের ধরণ
  • বিভিন্ন ধরনের জাতের সুবিধা – অসুবিধা
  • বিবিধ ব্যবহারের উপযোগী বিবিধ জাত
উন্নত জাত উচ্চ ফলনের বুনিয়াদ তৈরি করে। তাই চাষে ভালো ফলন পেতে হলে জাত বাছাই-এর ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। প্রজনন পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে ভুট্টার (প্রচলিত ও কৃষকপ্রিয় ) জাতকে দু’ ভাগে ভাগ করা হয়। কম্পোজিট ও হাইব্রিড।
এই দু’ ধরনের জাতের মধ্যে হাইব্রিড জাতের ফলনক্ষমতা অপেক্ষাকৃত বেশি। তবে হাইব্রিড জাতের বীজ দু’টি ভিন্ন জাতের সংকরায়নে উদ্ভূত প্রথম অপত্য বংশ বলে এক বার চাষের পর উৎপাদিত দানা পরের বার চাষের জন্য সংরক্ষণ করা যায় না। প্রতি বার চাষের জন্য নতুন করে বীজ সংগ্রহ করতে হয়।
অন্য দিকে কম্পোজিট জাত উদ্ভাবিত হয় গুটিকয়েক পছন্দসই জাতের বীজ পাশাপাশি বুনে প্রকৃতির কোলে তাদের মধ্যে স্বত:স্ফূর্ত ইতর পরাগমিলনের সুযোগ তৈরি করে। ভুট্টা ইতর-পরাগি শস্য। বাতাসে পুরুষ ফুল থেকে পরাগ বয়ে এনে স্ত্রী ফুলের গর্ভমুণ্ডে নিক্ষেপ করে। ফলে নিষেক সম্পন্ন হয়। তৈরি হয় বীজ। এই বীজগুলো আসলে সংকর বীজ। এই ভাবে পাশাপাশি বোনা সবক’টি গাছের সংকর বীজ একসাথে মিশিয়ে তৈরি হয় একটি কম্পোজিট জাত। এই কম্পোজিট জাত চাষের সময় কৃষকের মাঠেও অনুরূপ ভাবে বাতাসবাহিত পরাগ পাশাপাশি বেড়ে ওঠা নিকটবর্তী গাছের গর্ভমুণ্ডে পড়ে দানা উৎপাদিত হবে। ফসল কাটার পর দানাই হবে ওই কম্পোজিট জাতের বীজ। এই ভাবেই বীজ কোম্পানি কম্পোজিট জাতের বীজ তৈরি করে। সুতরাং কৃষকের মাঠের কাটা ভুট্টার মোচা (কব) মাড়াই করে যে দানা পাওয়া যায় তা স্বচ্ছন্দে পরের চাষে ব্যবহার করার জন্য সংরক্ষিত করা যাবে। প্রতি বার চাষের জন্য নতুন বীজ কেনার দরকার হয় না।
প্রজনন পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে বিভাজিত এই দু’ ধরনের জাত ছাড়াও ভুট্টার নানা ধরনের জাত আছে যেমন — ও পি জাত, সিনথেটিক জাত ইত্যাদি। এই ধরনের জাতের মধ্যে ও পি জাতের চল সীমিত হলেও সিনথেটিক জাতের বীজের এখন আর চল নেই।
ও পি জাতের বীজ কম্পোজিট জাতের মতোই প্রতি বার কিনে চাষ করতে হয় না। ফসল কাটার পর যে দানা পাওয়া যায় তার কিয়দংশ বাঁচিয়ে পরের বার চাষের জন্য ব্যবহার করা যায়।
হাইব্রিড জাতের মধ্যেও আবার ভাগ আছে। দু’টি জাতের মধ্যে সংকরায়নে উদ্ভাবিত জাতের নাম সিঙ্গল ক্রস হাইব্রিড, তিনটি জাতের মধ্যে সংকরায়ণে উদ্ভাবিত জাতের নাম থ্রিওয়ে ক্রস এবং চারটি জাতের সংকরায়নে উদ্ভাবিত হাইব্রডের নাম ডবল ক্রস। বর্তমানে ডবল ক্রস কিংবা থ্রিওয়ে ক্রসের মাধ্যমে উদ্ভাবিত জাতের চল নেই। বাণিজ্যিক ভাবে প্রচলিত সব হাইব্রিড জাতই ডবল ক্রস।
তথ্যসূত্র :
  • ১ ) কৃষি দফতর, পশ্চিমবঙ্গ সরকার
  • ২ ) ইনস্টিটিউট অব এগ্রিকালচারাল সায়েন্স, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়


Comments