নারিকেল বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল। বাংলাদেশের সব জেলাতেই কম-বেশি নারিকেল জন্মায়। তবে উপকূলীয় জেলাসমূহে নারিকেলের উৎপাদন বেশি হয়। নারিকেলের শাঁসে প্রচুর পরিমাণে আমিষ, চর্বি, শর্করা ও ক্যালসিয়াম পাওয়া যায়। এছাড়া ডাবের পানি অত্যন্ত পুষ্টিকর ও সুস্বাদু। তাই পানীয় ও খাদ্য হিসেবে নারিকেলের প্রচুর চাহিদা আছে। বারি নারিকেল-১ ও বারি নারিকেল-২ গাছে গড়ে ৬৫-৭৫টি ফল ধরে। এছাড়া প্রতি বিঘা জমিতে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৪০০ কেজি নারিকেলের ফলন হয়।
নারিকেল চাষ
আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ পুষ্টির চাহিদা পূরণের জন্য ফলমূলের উপর নির্ভর করে। এ দেশে সারাবছরই বিভিন্ন ধরণের শাকসবজি ও ফলের চাষ করা হয়। নারিকেল বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল। এর ইংরেজি নাম Coconut বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে Cocos nucifera. বাংলাদেশের সব জেলাতেই কমবেশি নারিকেল জন্মায়। তবে উপকূলীয় জেলাসমূহে বিশেষ করে খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, ভোলা, চট্টগ্রাম, ফরিদপুর ও যশোর জেলায় নারিকেলের উৎপাদন বেশি হয়।
পুষ্টিগুণ
নারিকেলের শাঁসে প্রচুর পরিমাণে আমিষ, চর্বি, শর্করা ও ক্যালসিয়াম পাওয়া যায়। এছাড়া ডাবের পানিতে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান আছে।
ঔষধিগুণ
বিভিন্ন রকম পেটের সমস্যায় ডাবের পানি খুবই উপকারী।
ডাবের পানি ও নারিকেলের শাঁস অত্যন্ত পুষ্টিকর ও সুস্বাদু। বিভিন্ন রান্নায় নারিকেল ব্যবহার করা হয়। এছাড়া নারিকেল দিয়ে বিভিন্ন সুস্বাদু পিঠা, মোয়া ইত্যাদি তৈরি করা হয়। তাই পানীয় ও খাদ্য হিসেবে নারিকেলের প্রচুর চাহিদা আছে। গৃহ নির্মাণ সরঞ্জাম, পশু খাদ্য ইত্যাদি উপকরণ নারিকেল থেকে পাওয়া যায়। নারিকেলের গাছের পাতা জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। নারিকেল গাছের প্রতিটি অংশই কোন না কোন কাজে লাগে। তাই নারিকেল চাষ করে পারিবারিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বাড়তি আয়ও করা সম্ভব। এছাড়া দেশের চাহিদা মেটানোর পর অতিরিক্ত উৎপাদন বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব। এক্ষেত্রে বিভিন্ন রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান সহায়তা দিয়ে থাকে। নারিকেল বিদেশে রপ্তানি করার জন্য এসব প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করা যেতে পারে।
* চাষের উপযোগী পরিবেশ ও মাটি
জলবায়ু
|
মাটির প্রকৃতি
|
জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি থেকে আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি সময় নারিকেল চাষের উপযুক্ত সময়।
|
নারিকেল গাছের জন্য নিকাশযুক্ত দো-আঁশ থেকে পলি দো-আঁশ মাটি সবচে উত্তম।
|
জাত
* উচ্চফলনশীল কয়েকটি নারিকেলের জাত :
নাম
|
প্রতিটি ফলের ওজন
|
পানির পরিমাণ
|
শাঁসের ওজন
|
তেলের পরিমাণ
|
বারি নারিকেল-১
|
২৭০-১৪০০ গ্রাম
|
২৭০-২৯০ মিলি
|
৩৭০-৩৯০ গ্রাম
|
৫৫-৬০%
|
বারি নারিকেল-২
|
১.৫-১.৭ কেজি
|
৩৩০-৩৪৫ মিলি
|
৩৫০-৩৭০ গ্রাম
|
৫০-৫৫%
|
এছাড়াও টিপিকা সবুজ, টিপিকা বাদামী ও দুধে জাতের নারিকেলের চাষ হচ্ছে।
তথ্যসূত্র : কৃষি প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল, জুন ২০০৭, Microfinance for Marginal and Small Farmers (MFMSF) Project, প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট সেল-১, পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ), ঢাকা।
চারা রোপণ পদ্ধতি
১. ৮ মি.X ৮ মি. দূরে চারা রোপণ করতে হবে।
২. চারা রোপণের আগে ১ মি. X ১ মি. X ১ মি. মাপের গর্ত তৈরি করে নিতে হবে।
সার প্রয়োগ
কৃষকদের মতে গুণগত মানসম্পন্ন ভালো ফলন পেতে হলে নারিকেল চাষের জমিতে যতটুকু সম্ভব জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। মাটি পরীক্ষা করে মাটির ধরণ অনুযায়ী সার প্রয়োগ করতে হবে। তবে জৈব সার ব্যবহার করলে মাটির গুণাগুণ ও পরিবেশ উভয়ই ভালো থাকবে। বাড়িতে গবাদি পশু থাকলে সেখান থেকে গোবর সংগ্রহ করা যাবে। নিজের গবাদি পশু না থাকলে পাড়া-প্রতিবেশি যারা গবাদি পশু পালন করে তাদের কাছ থেকে গোবর সংগ্রহ করা যেতে পারে। এছাড়া ভালো ফলন পেতে হলে জমিতে আবর্জনা পচা সার ব্যবহার করা যেতে পারে। বাড়ির আশে-পাশে গর্ত করে সেখানে আবর্জনা, ঝরা পাতা ইত্যাদি স্তুপ করে রেখে আবর্জনা পচা সার তৈরি করা সম্ভব।
সেচ ও নিষ্কাশন
১. শুষ্ক মৌসুমে ১৫ দিন পর পর ২ বার সেচ দিতে হবে।
২. বর্ষা মৌসুমে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
ফল সংগ্রহ
কচি অবস্থায় ফলের রঙ সবুজ হয়। পাকা অবস্থায় নারিকেলের রঙ খয়েরি হয়। তখন নারিকেলের গায়ে চুলের মত চিকন দাগ পড়ে। তখন ফল সংগ্রহ করতে হবে।
উৎপাদিত ফলের পরিমাণ
বারি নারিকেল-১ ও বারি নারিকেল-২ গাছে গড়ে ৬৫-৭৫ টি ফল ধরে। এছাড়া প্রতি বিঘা জমিতে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৪০০ কেজি নারিকেলের ফলন হয়।
* ১বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমিতে ফসল উৎপাদন খরচ
খরচের খাত
|
পরিমাণ
|
আনুমানিক মূল্য (টাকা)
|
বীজ/চারা
|
৫০টি
|
১০০০
|
শ্রমিক
|
৪ জন (৩ দিনের জন্য)
|
১৮০০
|
সার
|
প্রয়োজন অনুসারে জৈব সার
|
এই সার বাড়িতেই তৈরি করা সম্ভব। তাই এর জন্য অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন নেই।
|
বিকল্প হিসেবে (মাদা প্রতি)
টিএসপি=১৩০ গ্রাম (১ কেজি=২৩ টাকা)
ইউরিয়া=২০০ গ্রাম (১ কেজি=১৫ টাকা)
এমপি=২২৮ গ্রাম (১ কেজি=২৮ টাকা)
জিপসাম=৬৫ গ্রাম (১ কেজি=১২ টাকা)
জিংক সালফেট=২৫ গ্রাম (১ কেজি=৮০ টাকা)
|
৫০
| |
কীটনাশক
|
প্রয়োজন অনুসারে জৈব বা রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার
|
নিজস্ব/দোকান
|
জমি ভাড়া
|
একবছর
|
৪০০০
|
মাটির জৈব গুণাগুণ রক্ষা ও উৎপাদন খরচ কমানোর জন্য জৈব সার ও জৈব কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে লাভের পরিমাণ বাড়তে পারে।
|
তথ্যসূত্র : মাঠকর্ম, চাটমোহর, পাবনা, অক্টোবর ২০০৯
মূলধন
এক বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমিতে নারিকেল চাষের জন্য প্রায় ৫০০০ টাকার প্রয়োজন হবে। মূলধন সংগ্রহের জন্য ঋণের প্রয়োজন হলে নিকট আত্মীয়স্বজন, সরকারি ও বেসরকারি ঋণদানকারী ব্যাংক বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিও)-এর সাথে যোগাযোগ করা যেতে পারে। সরকারি ও বেসরকারি ঋণদানকারী ব্যাংক বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিও) শর্ত সাপেক্ষে ঋণ দিয়ে থাকে।
নারিকেল চাষের আগে অভিজ্ঞ কারও কাছ থেকে নারিকেল চাষ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিতে হবে। এছাড়া চাষ সংক্রান্ত কোন তথ্য জানতে হলে স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তা অথবা উপজেলা কৃষি অফিসে যোগাযোগ করা যেতে পারে। এছাড়া বাংলাদেশে প্রতিটি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের কৃষি বিষয়ক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আছে। এসব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্ধারিত ফি-এর বিনিময়ে কৃষি বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে।
নরিকেল বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অর্থকারী ফসল। বাংলাদেশের সব জেলাতেই নারিকেল জন্মায়। তাই বাণিজ্যিক ভিত্তিতে নরিকেল চাষ করে পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি অতিরিক্ত উৎপাদন বাজারে বিক্রি করে বাড়তি আয় করা সম্ভব।
Comments
Post a Comment